বুশি ওর উপরেও এককাঠি।বুশিকে আনা হয় আমাদের বাড়ি যখন ওর বয়স একমাস সাত দিন।ছোট্ট সাদা তুলোর বলের মতো বুশি সারা বাড়িতে ঘুর ঘুর করে বেড়াত। আমার অন্নপ্রাশনের একটা ব্যবহার না করা বাটিতে করে ল্যাকটোজেন খেত। আর সারা ঘরে ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল করে জলবিয়োগ করে রাখত। যখন বুশির প্রোমোশন হল ল্যাকটোজেন থেকে সেরিল্যাকে, সেদিন বাটিতে সেরিল্যাক দিতে না দিতে সব শেষ। পুরো হালুম আর হুলুম।
তারপরে বুশি আস্তে আস্তে কালের নিয়ম অনুযায়ী বড় হল। আর তেমন হতে লাগল ব্যাটার মেজাজ। বাড়ি শুদ্ধু সক্কলকে অন্তত কম করে পাঁচ বার কামড়েছে। আমাকে তো বোধহয় সবমিলিয়ে যত বার কামড়েছে তা প্রায় সেঞ্ছুরির কাছাকাছি। বেশি বই কম নয়। একবার মনে আছে, আমি আর গুবো টিভির ঘরে বসে আছি। আমি বোধহয় চেয়ারে আর গুবো আলনাতে হেলান দিয়ে মেঝেতে। বুশি গুবোর পায়ের থেকে ফুট তিনেক দূরে ঘুমোচ্ছে। আচমকা কি মনে হল, উঠে গুবোর ডান পাটাকে আচ্ছা করে মুখে পুরে কামড়ে কুমড়ে আবার যেখানে ছিল, সেখানে গিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়ল। গুবো বেচারা শকের চোটে মুখ দিয়ে একটা আওয়াজো বার করতে পারে নি।
আরেকবার কামড়াল পিকুকে। বুশি তখন বারান্দাতে বসে, মন দিয়ে পিছনের পা দিয়ে ডান কানটা চুলকোচ্ছে, আর পিকু মন দিয়ে সেটা দেখছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ পিকু হাত বাড়িয়ে গেছে দেয়ালা করতে। যেই না বলেছে, "বুশি, আয় আয় লে লে চুচু" আর যায় কোথায়- গল্পের শেষে, পিকু পাল মেডিকেল হলের সামনে বসে ইঞ্জেকশনের ভয়ে প্রবল শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে আর দরদর করে ঘামছে, আর আমরা সব্বাই ওকে ঘিরে ভরসা দিচ্ছি, "কিচ্ছু হবে না, দু সেকেন্ডের ব্যাপার। ডেঁয়ো পিঁপড়ের কামড়েও এর থেকে বেশি লাগে।" আরেক বার জনকে তাড়া করে মাঠ পার করে দিয়েছিল।
তবে বাবাকে কখনো কামড়ায়নি। কেননা বাবার কাছে পেত সব থেকে বেশি লাই। বুশি এক জনকে কামড়াত আর বাবা এসে বলত, "কেন, তুই নিশ্চয়ই কিছু করেছিলিস?" আর অনন্যাকেও কামড়ায়নি। কেন জানি না, কিন্তু কামড়ায়নি। অনন্যার সাথে ওর সম্পর্কটা একটু অন্য রকম, একটু সম্ভ্রমই করত বোধহয়। তবে খেতে দিলে ধারে পাশে মা ছাড়া কেউ যেতে পারতনা।
আর সাংঘাতিক বুদ্ধি। কোনোদিন ওকে তেমন করে টয়লেট ট্রেইন করানো হয়নি। তবে বাইরে নির্দিষ্ট সময়ে যখন নিয়ে যাওয়া হয় তখন ছাড়া যদি বড় বা ছোটো বাইরে পায়, ব্যাটা ঠিক বাথরুমেই যাবে। আর ভগবান চাইলেন না বলে বাংলাটা বলতে পারে না। নইলে বুশির সামনে বুশির অপছন্দের কোনো কথা, বাংলাতে বলা যাবে না। ধরা যাক, সাহেব শোয়ার ঘরে আরাম করে বসে আছে, আর ওকে ওখান থেকে সরানো দরকার। বা ওর সম্পর্কে ওর সামনে যদি কেউ মনের ভুলে বলে ফেলে, "সেকি বাড়ির কুকুর, কামড়ায়, এ কী রকম অসভ্যতা।" ভগবানের অপরিসীম করুণা ছাড়া সে পায়ে পট্টি না বেঁধে, টিটেনাস ইঞ্জেকসন না নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারত না। বুশির সামনে এমন কোনো কথা বলতে হলে আমরা বাড়ির লোকেরা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতাম আর নইলে ইংরেজীতে বলতাম। তাও যতটা পারা যায় শক্ত করে। মানে, "Where are you going" নয়, প্রায় "Where is the destination of thou perambulation" এর মত ইংরেজী।
তবে শেষের দিকে আর পারতনা। ভারী শান্ত আর মিষ্টি হয়ে গেছিল কুকুরটা। গত সপ্তাহে যখন ছেড়ে চলে গেল, তখন ওর চোদ্দ বছর বয়স। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কয়েকদিন। যেদিন স্যালাইন দেওয়া হবে ঠিক, সেইদিন সকালে উঠে বাথরুমে গেল। এসে একটু খানি বারান্দাত্তে বসল আর তারপরেই আস্তে আস্তে সময়ের ডাকে সাড়া দেওয়া শুরু। মায়া কাটিয়ে বলে যেতেও পারছিলনা। মুখে চোখে একটু জল দেওয়া হল, আর বাবা যেই একটু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, ওই টুকুর অপেক্ষাতেই ছিল বোধহয়, সব শেষ।
একটা যুগ শেষ হয়ে গেল বুশির সাথে। আমার কৈশোর, এগারো-বারো ক্লাসের বাওয়াল, কলেজের প্রেম, প্রথম বাড়ির বাইরে বের হওয়া, ফিরে আসা, পুরোনো দেয়াল ভেঙ্গে নতুন দেওয়াল, নতুন ঘর-বাড়ি, পুরনো বারান্দাতে চেনে বাঁধা বুশি, নতুন বারাব্দাতে গ্রিলের গেটে মুখ দিয়ে বসা বুশি, বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া বুশি, আমার সামান্য বদচলনে নিয়মিত শাসন করা বুশি, আমার বিয়েতে একটুও আওয়াজ না করে ঘন্টার পর ঘন্টা ছোট্ট ঘরটাতে বন্ধ হয়ে থাকা বুশি, আমার দোতলার ঘরে বাবার সাথে আমার ২য় বার প্রবাসে আসার পরে রোজ অনলাইনে কথা বলতে আসত। আওয়াজ করে জানান দিত ও-ও আছে। বাবা অফিস থেকে ছুটি পেয়ে গেছে এক বছর হল, আমিও আবার বাইরে এক বছর হল, সময়ও পালটে গেছে সময়ের ধর্মেই। তাও বুশি ছিল নিজের মেজাজে।
যখন বুশিকে বলা হত "চল বেড়াতে যাবো"-বুশি ছুট্টে গিয়ে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত আমাদের জন্য। আশা করি, ওই একই ভাবে সময়ের সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য ও অপেক্ষাতে থাকবে আবার একবার সবাই মিলে একসাথে হাঁটার জন্য।
1 comment:
poRlaam.... khub bhalo likhechhish, bushi'r kotha ta shune dukhyo holo.. or sathe amar shomporko ta nehat kharap na, kamRay ni kintu ekbaro!!!
Post a Comment