“সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়....তখনি পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ, ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে.” – শক্তি চ্যাটার্জী
বরোদাতে আমাদের কয়েকজনের ছোট্ট একটি ব্যান্ড আছে. যার নাম কাইরন. আমরা মূলত চেষ্টা করি, যাতে পরবাসে থেকেও আমরা যতটা সম্ভব বাংলার বর্ত্যমান সঙ্গীতের ধারাকে বরোদাতে অব্যাহত রাখতে পারি এবং তার সাথে সাথে যতদুর সম্ভব বরোদাতে সাধারণ বাঙালি শ্রোতাকে এবং শিল্পীদের নিয়ে একত্রিত করে বাংলা থেকে বহু দুরে একটি ছোট্ট বাংলা সৃজন করতে পারি. এ বিষয়ে বরোদার একটি অন্যতম বৃহত সংগঠনের অভিভাবকত্ত্ব আমরা পেয়েছি, আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই. বরোদাতে আরো বিভিন্ন মানুষ এবং বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছেন বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির ক্রম প্রচারের জন্য. তাদের আমাদের প্রণাম.
তো এইভাবে সুখে দিন যাপনের মাঝে সম্প্রতি আমাদের কাছে একটি অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব আসে. এই উদ্যোক্তাদের থেকে আমরা আগেও ডাক পেয়েছি এবং তাঁরা বহুদিন ধরে বরোদাতে বাংলা সংস্কৃতির প্রচারে যত্নশীল বলে তাঁরা দাবী করে থাকেন. আমাদের তাদের সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল এবং তাতে সামান্য যদি কিন্তুর অবকাশ থাকলেও আমরা তা বরাবর খুব যত্ন সহকারে অবজ্ঞা করে এসেছি. তাঁরা যে বিশাল পরিসরে তিন দিন ব্যাপী কলকাতার বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাতে সামান্য উনিশ বিশ হওয়া অসম্ভব নয়. আমাদেরও নিজস্ব একটা দায়িত্ব থাকে এবং বরাবর থাকবে যারা এই রকম কোনো উদ্যোগে নিজেকে নিয়োজিত করছেন তাঁদের পাশে দাঁড়ানো. আমাদের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানের পিছনে বেশ কিছু খরচ খরচা থেকে যায়, কারণ আমাদের যে পরিকাঠামো রয়েছে, তার যাতায়াতের জন্য, এবং তা ছাড়াও, যদি কোনো পেশাদারী শিল্পী আমাদের সাথে বাজান, তাঁর জন্য একটি যথা সম্ভব সাম্মানিকের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন থাকে. তা সত্ত্বেও যখন আমাদের কাছে এই প্রস্তাবটি আসে, তখন আমরা এক কথাতে কোনো রকম কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই অনুষ্ঠান করতে রাজী হই, শুধুমাত্র তাঁদের উদ্যোগকে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করা সম্ভব, তার জন্য.
আমি জানি না, তাঁরা আমাদের এই ভদ্রতাকে আমাদের দুর্বলতা বলে দেখলেন কি না. প্রথম প্রতিবন্ধকতা আমরা পেলাম শব্দের প্রয়োজন জানাতে গিয়ে. আমাদের মতো একটি গানের দল, যারা মূলত বৈদ্যুতিন যন্ত্র সহযোগে গান করে, তাদের একটা ন্যুনতম শব্দের (ধ্বনি)প্রয়োজন থাকে. আমরা সেই প্রয়োজন জানানোর পরে বহু সময় অবধি দেখছি, দেখবো, হচ্ছে হবে করে শেষ সময়ে বলা হলো, যেহেতু এটি মূলত নাটকের অনুষ্ঠান, শব্দ প্রক্ষেপণে এরূপ বাহুল্য (!) সম্ভব নয়. আমরা যেন ঠিক করে জানাই আমরা অনুষ্ঠান করতে ইচ্ছুক কি না, নইলে তাঁদের অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে. যাঁর কাছ থেকে আমরা এই বার্তা পাই, তিনি আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ. আমরা নির্দ্বিধায় তাঁকে ফোন করি, এবং তাঁকে বলি, আমাদের ন্যুনতম প্রয়োজন এটাই এবং এটা না হলে আমরা অনুষ্ঠান করতে পারবো না. তিনি আমাদের বলেন, তিনি তাঁর যথা সাধ্য চেষ্টা করবেন. তিনি তা করেছেন এবং যা প্রতিশ্রুত তার থেকে কিছু বেশিই করেছেন. আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই.
অনুষ্ঠানের দিন, অর্থাৎ ২রা জুলাই, আমাদের বলা হয় একটু তাড়াতাড়ি প্রেক্ষাগৃহে পৌছে যেতে, কেননা, আমাদের আগেই বলা ছিল যে আমাদের যন্ত্রপাতিগুলির সম্পুর্ন শব্দ মিলিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে. উদ্যোক্তারা জানান তাঁরা ঠিক ৭-৩০ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু করতে চান. আমরা আমাদের সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে সন্ধ্যা ৬-৩০ টার মধ্যেই সি সি মেহতা প্রেক্ষাগৃহে পৌছে যাই. এর পরে যা হয় তা আমাদের যেমন এখনো অবাক করছে, তেমনি দুঃখও দিয়েছে. আমরা কেউই পেশার জন্য গান করি না এবং যার যার ক্ষেত্রে সামান্য হলেও কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করে আমরা যার যার ক্ষেত্রে একটা সামান্য হলেও জায়গাতে দাঁড়িয়েছি. এদিনের ঘটনা আমাদের সেই শিক্ষাকে চরম আঘাত করেছে. আর আমরা যে সামান্য গান বাজনা করি, তাতে আমরা যে একটা বিশেষ কিছু, সেই রকম দাবী আমরা একদমই রাখি না. তবে এর দৌলতে আমাদের বেশ কিছু মানুষের কাছে আসার সৌভাগ্য হয়েছে. তাদের কাছে আমরা শুধু গান বাজনাই শিখি নি, আমাদের যা সামান্য সংস্কৃতির শিক্ষা, তাও তাঁদের কাছে. তাঁরা গোটা রাজ্যে এবং দেশে তাঁদের নিজ ক্ষেত্রে প্রবাদপ্রতিম. আমাদের মতো অর্বাচীনদের পরম সৌভাগ্য তাঁদের কাছে শিক্ষা লাভ করা. এখানে তাঁদের নাম বলে, তাঁদের ছোট করার ধৃষ্টতা আমি করবনা. তাঁরা আমাদের শিখিয়ে ছিলেন, শিল্পী যতই ছোট হোক, তিনি শিল্পী. সর্বদা তাঁর প্রাপ্য সম্মান তাঁকে দিতে হয়. আমার নিজের গুরুকে দেখেছি, দশ বছরের একটি ছোট ছেলে, শিখতে এসেছে একদমই নতুন. তিনি তার সাথে এমন আদরে কথা বলছেন, যেন সে তাঁর সমমানের শিল্পী. আর সেদিন আরেকটুর জন্য আমাদের বলা হয় নি ;- “ওহে, এতক্ষণ যে এস্টেজে দাঁড়িয়ে গান করলে, ঝাঁটটা দেবে কে?”